বর্তমানে ইতিহাসের নিরিখে আনারকলির সন্ধান করতে গেলে আমাদের লাহোর যেতে হবে। সেখানে পাঞ্জাবের সচিবালয়ের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি সমাধিসৌধ, যা আনারকলির সমাধি বলে পরিচিত। বহুবার ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাধিও হাতবদলের শিকার হয়ে বর্তমানে পাঞ্জাব সরকারের আর্কাইভ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ভাবতে কিছুটা অবাকই লাগে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মোগল সম্রাটের উপপত্নী (মতান্তরে বাইজি) যাকে এবং সম্রাটের পুত্রকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল উপকথা, তার সমাধির এ কী হাল! অবশ্য ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আনারকলির সমাধি থাকারই কথা নয়, এমনকি আনারকলির অস্তিত্ব নিয়েও আছে প্রশ্ন। কিন্তু লাহোরের এ সমাধিই বলা চলে আনারকলিকে পুনর্জীবিত করে।

আনারকলির এ সমাধি মোগল স্থাপত্যের একটি সাধারণ নিদর্শন হয়েও গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি পাঞ্জাব অঞ্চলে মোগল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। খাইবার পেরিয়ে আসা মোগলদের জন্য উত্তর-পশ্চিম ভারত বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু মোগল শাসনের কেন্দ্র উত্তর ভারতে হওয়ার কারণে দিল্লি-আগ্রায় নানা বৃহৎ স্থাপনা তৈরি হলেও পাঞ্জাব সে তুলনায় পিছিয়ে থাকে। এই পাঞ্জাবেই ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে আনারকলির সমাধি নির্মিত হয়। সমাধির গায়ে থাকা লিপি থেকে দুটি তারিখ পাওয়া যায়—১৫৯৯ ও ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দ। ধারণা করা হয়, এর প্রথমটি আনারকলির মৃত্যু এবং পরবর্তীটি সমাধিসৌধ নির্মাণ সমাপ্তির সময় নির্দেশ করে।

সমাধিটি লক্ষ করলে মোগল স্থাপত্য রীতির সঙ্গে এর মিল সহজেই পাওয়া যায়। মোগলদের প্রিয় চারবাগ ঘরানার বাগানের অভ্যন্তরে সমাধির অবস্থান। অষ্টভুজাকৃতি ভিত্তির ওপর মূল দালানটি গোলাকার বলা চলে, তবে মূলত সেটিও অষ্টভুজ। দৃষ্টিনন্দন করার জন্য স্থাপত্য কৌশল হিসেবে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে একে যথাক্রমে ৪৪ ও ৩০ ফুট রাখা হয়েছে। চারপাশে রয়েছে দেয়ালের তুলনায় উঁচু মিনার। মিনারের ওপর খালি জায়গা এবং প্রতিটি মিনারে ওপর আলাদা ছোট গম্বুজ ছাড়াও মধ্যভাগে একটি বড় গম্বুজ (ডাবল ডোম) রয়েছে। অষ্টভুজের প্রতিটি কোণে ১২ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার একটি করে আটটি খুঁটির ওপর বিস্তৃত এ গম্বুজের অবস্থান। স্থাপনার বাইরের দিকে বর্তমানে একটি সিঁড়ি দেখা যায়, যা মূল পরিকল্পনায় ছিল না। শবাধারটির অবস্থান পূর্ব দিকের দুই খিলানের মধ্যকার প্রবেশপথের ওপর থাকা একটি জানালার ঠিক নিচে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে এর অবস্থান সমাধির কেন্দ্রেই ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সমাধিটি গির্জায় পরিণত হলে শবাধারটি সরিয়ে আনা হয়। আনারকলির এ সমাধির সার্বিক পরিকল্পনার সঙ্গে আসফ খানের (নূরজাহানের ভাই) সমাধির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এ সাদৃশ্য উল্লেখ করার কারণ জাহাঙ্গীরের সময়েই যে এ সমাধি তৈরি হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়।

এ সমাধিকে আনারকলির সমাধি বলা হলেও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। যে স্থানে সমাধির অবস্থান তার নাম ‘আনারকলি বাজার’ এবং যে বাগানের অভ্যন্তরে সমাধির অবস্থান তার নাম ‘আনারকলি বাগ’। প্রশ্ন ওঠে, আনারকলির সমাধির কারণে অঞ্চলের এ নাম হয়েছে, নাকি আনারকলি বাগ নামের সঙ্গে সালিম-আনারকলির প্রেমকথা মিলে গিয়ে সমাধির নাম আনারকলি সমাধি হয়েছে? দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিও ফেলে দেয়া যায় না। কেননা সমসাময়িক ইতিহাস লেখক, দরবারের ‘ওয়াকিয়ানবিশ’ (দৈনিক ঘটনাবলি লেখক) কেউই আনারকলি সম্বন্ধে লেখেননি। এমনকি খোদ সালিম—পরবর্তী সময়ে বাদশাহ জাহাঙ্গীর—একটি অন্তরঙ্গ আত্মজীবনী লিখলেও সেখানে আনারকলির স্থান হয়নি।

তবে নানা কারণে আবার এটাও বিশ্বাস করা যায় যে সমাধিটি সত্যিই আনারকলির। সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে যে মূল সমাধিটি রয়েছে সেখানে সত্যিই কেউ ঘুমিয়ে আছেন কিনা তা জানা না গেলেও মার্বেল পাথরে তৈরি কবরটির গায়ে আল্লাহর ৯৯ নাম নাস্তালিক লিপিতে লেখার পাশাপাশি এখানে ফারসি কবি সাদীর কবিতা থেকে দুটো চরণ উদ্ধৃত করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘ফের যদি আমার প্রিয়ার মুখ একবার দেখতে পেতাম/ রোজ কেয়ামত পর্যন্ত খোদার শোকর গুজার হতাম।’ যদিও চরণদ্বয় সাদীর কবিতা থেকে নেয়া, চরণের শেষে লেখা হয়েছে ‘মজনুন সালিম আকবর’। এ নিবন্ধ তৈরির পাশাপাশি মোগল আমল, আকবর, সালিম ও আনারকলি সম্পর্কে পাওয়া নানা তথ্য থেকে আমার বিশ্বাস আনারকলির সমাধিতে নিজের নামের পাশে পিতার নাম বসানোর মাধ্যমে সালিম মূলত তার পিতা আকবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।

সমাধিতে সাদীর কবিতার সঙ্গে সালিমের নামের উপস্থিতির মাধ্যমে একদিকে যেমন এ সমাধির সঙ্গে আনারকলির সংযোগ নিশ্চিত হওয়া যায় তেমনি সমাধি ও আনারকলি সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি তত্ত্বকে পরীক্ষা করা যায়। প্রচলিত আছে, আনারকলিকে আকবর হত্যা করিয়েছেন কিংবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। পাশাপাশি আরেকটি মত হলো আকবর অন্যত্র থাকাকালীন আনারকলির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আকবরের প্রত্যাবর্তনের পর আনারকলির স্মরণে একটি সৌধ তৈরির নির্দেশ দেন। আনারকলি ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তার ছয় বছরের মাথায় আকবরের মৃত্যু হলে এ সমাধির স্থাপনা তার পক্ষে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সমেয় জাহাঙ্গীর এর নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন এবং এ কারণেই নিজের নামের সঙ্গে পিতার নামও যুক্ত করেছেন।

পরবর্তীকালে উনিশ শতকের ইতিহাসবিদ নূর আহমেদ চিশতি তার ‘তেহকিকাত-ই-চিশতিয়া’য় (১৮৬০) লিখেছেন, ‘আনারকলি আকবরের প্রিয় এক উপপত্নী ছিলেন এবং তার জন্য আকবরই এ সমাধি নির্মাণ সূচনা করেন।’ ১৮৯২ সালে ‘তারিখ-ই-লাহোর’-এ সৈয়দ আব্দুল লতিফও এ পুরনো কথার প্রতিধ্বনি করে আনারকলির আসল নাম শরিফ-উন-নিসা বলে জানান এবং তারও মত, লাহোরের এ সমাধি আনারকলি নাম্নী সেই শরিফ-উন-নিসার স্মৃতিতে নির্মিত। কিন্তু চিশতি, সৈয়দ লতিফ ও কানাইয়া লালের মতের বিপরীতে গিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আবদুল্লাহ চাগাতাই একটি ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তার মতে, আনারকলি বাগের এ সমাধি মূলত জাহাঙ্গীরের অন্যতম প্রিয় স্ত্রী সাহিব জামালের স্মরণে নির্মিত। কিন্তু আনারকলি সম্পর্কিত লোককথা এবং সমাধি সন্নিহিত আনারকলি বাগের কারণে ধীরে ধীরে এটি আনারকলি সমাধি হিসেবে পরিচিত হয়।

সে যা-ই হোক, সমাধির উপস্থিতি তো অস্বীকার করা চলে না। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো আনারকলির এ সমাধিও ব্যক্তি আনারকলির মতো বৈচিত্র্যময়। নির্মাণের ক্ষেত্রে এখানে আকবর ও সালিম উভয়ের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত। পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের সময় রণজিত্পুত্র খাড়াক সিং এর দখল নেন। খাড়াকের নির্দেশে এ সমাধি কমপ্লেক্সকে শিখ সেনাদলের ফরাসি অধিনায়ক জঁ ব্যাপ্টিস্ট ভেন্তুরার বাসস্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। পরে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে একে প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা বলেন, এ সময়ে সমাধিতে চুনকাম করে ইসলামী চিহ্ন ঢেকে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর স্বাভাবিক লালচে রঙও হারিয়ে যায়। এখানে একটি ক্রুশও বসানো হয়েছিল।

গির্জা হিসেবে ব্যবহারের সময় থেকেই ব্রিটিশ শাসকরা আনারকলির সমাধিকে নিজেদের পছন্দমতো বদলাতে আরম্ভ করে। সিপাহি বিদ্রোহ এবং পরবর্তী সময়ে অন্য অনেক মোগল স্থাপনা ও মোগল বিষয়াদির সঙ্গে সঙ্গে আনারকলির সমাধিও ব্রিটিশরা পুরোপুরি নিজেদের দখলে নেয়। পৃথিবীর সর্বত্রই সমাধিস্থল পবিত্র জ্ঞান করা হয়, ভারতেও ব্যতিক্রম নয়। আবার মোগল সমাধিগুলো এত বৃহৎ হতো যে সেখানে বসতি স্থাপন করাও সম্ভব হতো। মোগল আমলে বিদ্রোহীদের মধ্যে পরাজয়ের সময়ে বা নিরাপত্তার আশায় সমাধিতে অবস্থানের প্রচলন ছিল। সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে বাহাদুর শাহর পুত্ররাও লুকিয়েছিল সমাধিতে। আনারকলির সমাধি দখল করে ব্রিটিশ শাসকরা এর প্রবেশপথের কিছু অংশ বন্ধ করে দেয়। ১৮৫৭তে সমাধিকে সেন্ট জেমস গির্জায় পরিণত করা হয়, যা ১৮৯১ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এর পর থেকে পাঞ্জাব সরকারের আর্কাইভ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়, যদিও ততদিনে মূল সমাধি অনেকাংশে বদলে গেছে।

মার্বেল পাথরে তৈরি এ সমাধিকে বর্তমানে দেখলে চুনকাম করা একটা দালান ছাড়া কিছু মনে হয় না। কিন্তু ভেতরে এখনো চমত্কার একটি সমাধি, সমাধিফলক ও শবাধার রয়েছে। আনারকলি সম্পর্কিত সন্দেহের কারণ হিসেবে এখন অনেকেই তথ্যের অপ্রতুলতাকে দায়ী করেন। স্থানীয় গাইড সাঈদ মনে করেন, ‘সৌধের ক্রমাগত হাতবদল এবং খোদ আকবরের সময় থেকে নানা বিতর্কের কারণে সমাধির উপযুক্ত কদর করা হয়নি। এমনকি হয়তো আকবরের সময়ে আনারকলি সম্বন্ধে আলোচনা করাও নিষিদ্ধ হয়ছিল। ফলে সঠিক তথ্যের অভাবে ইতিহাসবিদরাও বিভিন্ন ধরনের কথা লিখেছেন।’

অনারকলির সমাধি সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু সংরক্ষিত অঞ্চল হওয়ার কারণে সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। অন্যদিকে সমাধির প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নন। এ অঞ্চলের এক অধিবাসী আসলামের মতে, মোশাররফ সরকারের পর সমাধি সংরক্ষণের কিছু কাজ হয়েছিল। এরপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর কিছুই করেননি। বাস্তবের আনারকলি, ইতিহাসের আনারকলির মতো আনারকলির সমাধিও আজ অবহেলিত।